হাওজা নিউজ এজেন্সি: আসসালামু আলাইকুম। হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা জয়নুল আবেদীন সাহেব, আপনাকে স্বাগতম। আজকের আলোচনার বিষয় হলো: "ইসরায়েলি ও ইরানি সংস্কৃতিতে যুদ্ধ কীভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে?"। চলুন শুরু করি সরাসরি একটি মূল প্রশ্ন দিয়ে—আপনি কীভাবে দেখেন, এই দুটি দেশের সংস্কৃতিতে যুদ্ধের ধারণাটি তৈরি হয়েছে?
হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা জয়নুল আবেদিন: ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। ধন্যবাদ। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। ইরান ও ইসরায়েল—দুই দেশের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ভিত্তি ভিন্ন হলেও যুদ্ধ নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু মিল ও পার্থক্য স্পষ্ট। ইরানি সংস্কৃতিতে যুদ্ধের ধারণা মূলত "প্রতিরোধ" ও "আত্মোৎসর্গ"-এর মধ্য দিয়ে গঠিত। ইমাম হোসাইনের কারবালার প্রেক্ষাপট এখনও তাদের যুদ্ধচেতনার মূল অনুপ্রেরণা। একে বলা যায় "মাজলুমের প্রতিরোধ"। তারা যুদ্ধকে একধরনের ন্যায়বিচারের সংগ্রাম হিসেবে চিত্রিত করে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলি সংস্কৃতি যুদ্ধকে দেখে “জীবন রক্ষার জন্য বাধ্যতামূলক আত্মরক্ষা” হিসেবে। হোলোকাস্টের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এক গভীর মনোভাব তৈরি করেছে। তাই ইসরায়েলি সাহিত্যে, সিনেমায়, এমনকি স্কুল পাঠ্যক্রমেও যুদ্ধকে আত্মরক্ষার একটি প্রয়োজনীয়তা হিসেবে তুলে ধরা হয়।
হাওজা নিউজ এজেন্সি: খুব ভালো একটি ব্যাখ্যা। তাহলে কি বলা যায়—ইরান যুদ্ধকে আদর্শিক ও নৈতিক প্রতিরোধ হিসেবে দেখছে, আর ইসরায়েল যুদ্ধকে বাস্তববাদী আত্মরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে?
হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা জয়নুল আবেদিন: এক কথায়, ঠিক তাই। উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। ইরানে “মুক্তিযুদ্ধ” (ডিফেন্স অব হলি শাইন) বা “শাহাদাত”-সংক্রান্ত গানের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যেই যুদ্ধচেতনা গড়ে তোলা হয়। সরকারি চ্যানেলগুলোতে শহীদদের স্মরণে অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়।
ইসরায়েলে আবার "ইয়াদ ভাশেম" (Yad Vashem) জাদুঘর, যেখানে হোলোকাস্টের স্মৃতি রক্ষিত, তা নাগরিকদের যুদ্ধ এবং আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তা শেখায়। তাদের সিনেমা, যেমন "Beaufort" বা "Waltz with Bashir", এসব ছবি যুদ্ধকে একদিকে গৌরবের, আবার অন্যদিকে মানসিক যন্ত্রণার প্রতিফলন হিসেবে দেখায়।
হাওজা নিউজ এজেন্সি: এটা কি বলা যায়, উভয় সংস্কৃতিতেই যুদ্ধকে কেবল বাহ্যিক সংঘাত হিসেবে নয়, বরং আত্মপরিচয় ও জাতীয় অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত এক আবেগের বিষয় হিসেবে দেখা হয়?
হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা জয়নুল আবেদিন: অবশ্যই। এই দু’টি সংস্কৃতি যুদ্ধকে কেবল অস্ত্রের সংঘর্ষ নয়, বরং তা একটি আধ্যাত্মিক এবং জাতীয় উপলব্ধির ক্ষেত্র হিসেবে চিত্রিত করে। ইরান যুদ্ধকে “মুকাবেলা” বা প্রতিরোধ হিসেবে দেখে, যেখানে ন্যায়ের জন্য জীবন দেওয়া মহৎ। অন্যদিকে ইসরায়েল যুদ্ধকে “সারভাইভাল”—অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই হিসেবে দেখছে।
হাওজা নিউজ এজেন্সি: সংস্কৃতিগত এই দৃষ্টিভঙ্গি কি বাস্তব রাজনীতিকে প্রভাবিত করে?
হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা জয়নুল আবেদিন: অবশ্যই করে। যখন একটি জাতি সাংস্কৃতিকভাবে যুদ্ধকে মহিমান্বিত করে, তখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সে আবেগকে কাজে লাগিয়ে জনসমর্থন আদায় করতে পারে। ইরানে ‘বাসিজ’ বাহিনী, যারা ধর্মীয় প্রেরণায় অনুপ্রাণিত, তাদের অস্তিত্বই সাংস্কৃতিক যুদ্ধচেতনার ফসল। অন্যদিকে ইসরায়েলে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ এবং “সাবর” মানসিকতা—একটি সাহসী, স্বাধীনচেতা ইহুদি নাগরিকের আদর্শ—এইসবই সাংস্কৃতিক চর্চার অংশ।
হাওজা নিউজ এজেন্সি: শেষ প্রশ্ন—এই সংস্কৃতিক চেতনা কি এই দুই জাতিকে শান্তির পথে নিয়ে যেতে পারে, নাকি আরও সংঘাতমুখী করে তুলছে?
হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা জয়নুল আবেদিন: একটু জটিল প্রশ্ন, তবে বলবো—যদি সংস্কৃতির মাধ্যমে যুদ্ধ মহিমান্বিত করা হয়, তাহলে তা শান্তির পথে বাধা হতে পারে। কিন্তু যদি সেই একই সংস্কৃতি ‘ন্যায়’ ও ‘মানবিকতা’কে গুরুত্ব দেয়, তাহলে তা শান্তিরও ভিত্তি হতে পারে। সুতরাং সংস্কৃতিকে কিভাবে পরিচালিত করা হচ্ছে, সেটাই মূল বিষয়।
আমাদের সমাজ এই প্রসঙ্গ থেকে শিক্ষা নিতে পারবে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মজিদুল ইসলাম শাহ
আপনার কমেন্ট